• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

পরিবেশ রক্ষায় পরিবর্তন দরকার

খটখটে শহরে রগরগে জীবন

  • ''
  • প্রকাশিত ২৯ এপ্রিল ২০২৪

এম এ বাবর:

গাছ-জলাশয়হীন কংক্রিটের ঢাকা শহরে কষ্ট বাড়ছে গরমে। তাপমাত্রার পারদ এ শহরে ৪০ ডিগ্রিও ছুঁয়েছে। ইট-পাথরের চাপায় ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার সবুজ রূপ। এখন উঁচু কোনো ভবন থেকে ঢাকা শহরকে দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। যতদূর চোখ যায় শুধু ঘরবাড়ির অরণ্য। প্রকৃত সবুজ অরণ্যের দেখা নেই। ছিটেফোঁটা যতটুকু সবুজের দেখা মেলে সেটুকু হচ্ছে নগর উদ্যান, না হয় জলাভূমির গাছগাছালি। নিচু জলমগ্ন জলাভূমিতেও নেই বৃক্ষ, আছে কিছু তৃণগুল্ম। প্রয়োজনীয় জলাভূমি ও গাছপালাহীন খটখটে শুকনো এ শহরটিতে মানুষের রগরগে (চকচকে) জীবন কাটছে যুদ্ধ করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি জনপদে জনগণের তিনগুণ গাছ থাকা দরকার। কিন্তু প্রায় দুই কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরে গাছ আছে হাতেগোনা কিছু? সঠিক সংখ্যা কারো কাছে না থাকলেও তা দুই-তিন লাখের বেশি হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এ শহরে প্রতিদিন নতুন নতুন বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হচ্ছে আর কেটে ফেলা হচ্ছে পুরোনো বাড়ির চারপাশে থাকা গাছ। এছাড়া সড়ক ও পার্কের উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা উন্নয়নের নামে ঢাকা শহরের বহু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে বৃক্ষতলের শীতল ছায়া। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০ বছর পর রাজধানীতে সৃষ্টি হতে পারে অক্সিজেনের স্বল্পতা।

এদিকে বিগত ৩৬ বছরে ঢাকার জলাভূমিরও প্রায় ৬০ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে। একই সঙ্গে কমেছে দেশি গাছ। আর শূন্যতা পূরণ করতে আনা হচ্ছে বিদেশি গাছ, যা পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর। বিদেশি গাছে কোনো পাখি বা প্রাণী বাস করে না। প্রাণীরা গন্ধ শুকেই বুঝতে পারে গাছ দেশি, না বিদেশি। তাছাড়া বিদেশি গাছে তারা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য হারাচ্ছে রাজধানী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ২ শতাধিক প্রজাতির বিদেশি গাছ রয়েছে। ইউক্যালিপটাস থেকে শুরু করে মানুষের কাছে অতি পরিচিত সেগুন ও রেইন ট্রিও বিদেশি গাছ। প্রাকৃতিক উপায়ে এসব বিদেশি গাছের বংশ বৃদ্ধি না হওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এরা ব্যর্থ। দেশি গাছ কমে যাওয়ায় গাছের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীও কমে যাচ্ছে। এতে রাজধানী হারাচ্ছে তার জীববৈচিত্র্য।

রাজধানীতে টানা তীব্র গরম চলছে ১৬ এপ্রিল থেকে। এরই মধ্যে তাপমাত্রার পারদ এ শহরে ৪০ ডিগ্রিও ছুঁয়েছে। অথচ দুই কোটির বেশি মানুষের এ শহরে দিনে দিনে ছায়া দেওয়ার মতো গাছ কমছেই। বাড়ছে কংক্রিটের দালানকোঠা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সর্বশেষ তথ্যমতে, ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে ঢাকা নগরাঞ্চলের সবুজ ও ফাঁকা জায়গা ৫২ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার হয়েছে। অর্থাৎ ২৯ বছরে ঢাকার সবুজ ও ফাঁকা জায়গা কমেছে ২২ দশমিক ৬৩ বর্গকিলোমিটার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ২০ শতাংশ স্থানে গাছপালা থাকা উচিত হলেও আছে মাত্র ২ শতাংশে। তুলনামূলক এক চিত্রে দেখা গেছে, ঢাকার অদূরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ এলাকায় গাছপালা ও ২২ শতাংশে জলাভূমি। এ কারণে একই সময় ঢাকার চেয়ে সেখানকার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা পার্ক এলাকার তুলনায় ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় তাপমাত্রা থাকে ২ ডিগ্রি বেশি; যা ঢাকার জীবনকে ভাবিয়ে তুলেছে।

ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌহিদুল ইসলাম গবেষণার নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০২০, ২০২১, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪- এই চার বছরে ১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত দেড় মাসের তাপমাত্রা তুলনা করে দেখেছি। বছরের এ সময়টায় তাপমাত্রা বেশি থাকে। দেখা গেছে, এ সময় জাহাঙ্গীরনগরের চেয়ে ঢাকায় তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি থাকে। জাহাঙ্গীরনগরের তাপমাত্রা কম থাকার কারণ, এখানকার গাছপালা, ওয়েট ল্যান্ডস (জলাভূমি), লতাগুল্মের সবুজ আচ্ছাদন।’

সরেজমিন দেখা যায়, আমিনবাজার ব্রিজের মুখ থেকে টেকনিক্যাল মোড় পর্যন্ত সড়কে ও দুই পাশের ফুটপাতের ওপর গাছের সংখ্যা ৩০টির বেশি না। বছরসাতেক আগেও ফার্মগেটে আনোয়ারা উদ্যান ছিল। এখন সেটি আছে শুধু নামে। অদূরেই কারওয়ান বাজারের পান্থকুঞ্জ পার্কেও অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। শাহবাগে শিশুপার্কে একসময় অর্ধেকজুড়ে ছিল গাছগাছালি। এখন শুধু শাহবাগ থানার পেছনের অংশে কয়েকটি পুরোনো গাছ আছে। এ ছাড়া মিরপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, আগারগাঁও, টেকনিক্যাল, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, কলাবাগান, ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোড়, নিউমার্কেট এলাকা, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, কাকরাইল, মৌচাক, রামপুরা, বাড্ডাসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সড়কে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য গাছ কাটা হয়েছে।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, একটি নগরের কুলিং সেক্টরের সব থেকে বড় উপাদান হলো গাছ ও জলাশয়। অথচ আমাদের এখানে এসব নষ্ট করা হয়েছে। দুই সিটির মেয়র লাখ লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিলেও তার উল্লেখযোগ্য বাস্তবায়ন দেখছি না। বৃক্ষের প্রতিস্থাপন কোনো দিনই চারা দিয়ে হয় না। তার পরও এই উদ্যোগে তাদের আন্তরিক হতে হবে। তাহলে বছরবিশেক পর গিয়ে আমরা ফলাফল পেতে পারি। তাই ঢাকাসহ দেশের পরিবেশ রক্ষায় প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক পরিবর্তন দরকার।

বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব প্ল্যান্ট টেক্সোনমি’তে গত বছর প্রকাশিত ‘ঢাকার লেকপাড়ের গাছের বৈচিত্র্য এবং গাছপালা’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা গেছে, ধানমন্ডি, হাতিরঝিল ও গুলশান লেকপাড়ে ১১৮ প্রজাতির ২ হাজার ৩২২টি গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ প্রজাতির গাছ আগ্রাসি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ঢাকা শহরে কত নতুন নতুন আবাসিক এলাকা হচ্ছে; সেখানে শুধু ২০ শতাংশ এলাকায় গাছ লাগানো গেলে স্থানীয় মানুষের জন্য তাপমাত্রা সহনীয় রাখা ও ছায়া দেওয়া সম্ভব। আর পরিবেশবান্ধব গাছ লাগালে এ সুবিধা আরও বেশি।

ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএস ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গ্রীষ্মকালের শুরু থেকে দেড় মাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও ঢাকা শহরের তাপমাত্রার পার্থক্য পরিমাপ করেছে। বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাকে। তাতে দেখা যায়, ২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগরের গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৪৭ ডিগ্রি। ঢাকায় ছিল ৩৯ ডিগ্রি। ২০২২ সালে ছিল যথাক্রমে ৩৪ ডিগ্রি ও ৩৭ দশমিক ২৬ ডিগ্রি, ২০২৩ সালে ৩৭ ডিগ্রি ও ৩৮ ডিগ্রি এবং এ বছর (২০২৪) ৩৩ ডিগ্রি ও ৩৬ ডিগ্রি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা খুব ভালো করেই জানি, আশপাশে গাছ থাকার সুফল। গাছ পরিবেশকে যে কতটা ঠান্ডা রাখতে পারে তা গরমকালে কোনো বৃক্ষের ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নিলেই বোঝা যায়। সরাসরি রোদ পড়ে মাটি গরম হয়ে ওঠে, দালান-কোঠা গরম হয়, পাকা রাস্তা গরম হয়। এ গরম অবস্থা ঠান্ডা হতে সময় লাগে। এজন্য সূর্যাস্তের পরও অনেকটা সময় শহর উষ্ণ থাকে। অথচ গাছপালা থাকলে তার ছায়ায় মাটি ও রাস্তা কম গরম হয়।

তিনি মনে করেন, গাছ রোপণের ক্ষেত্রেও প্রজাতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এমন প্রজাতির গাছ লাগাতে হবে, যার নিচে ঘাস ও লতাগুল্ম জন্মে। যেমন আকাশমণি, মেহগনি, রাবার, বেনজিন প্রজাতির গাছ এ দেশের মাটি, পানি ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ধরনের গাছ তাপমাত্রা কমানো বা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা কম রাখে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন বস্তি এলাকা ও রাস্তার পাশে গাছ লাগানো শুরু করেছি। পর্যায়ক্রমে আরও গাছ লাগানো হবে। তবে নগরবাসীকে তাদের ছাদ, বারান্দা ও বাড়ির পাশের খালি জায়গাতেও গাছ লাগাতে হবে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে পারব বলে আশা করি।’

সার্বিক বিষয়ে নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, এখন তো গাছ লাগানোর মৌসুম নয়। উপযুক্ত সময়ে আমরা গাছ লাগাচ্ছি। বেদখল হওয়া খালগুলো উদ্ধারে কাজ করছি, নতুন নতুন জলাধার সৃষ্টির কাজ চলছে। উন্নয়নকাজের জন্য যেসব জায়গার গাছ কাটা হয়েছে, সেগুলোয় বৃক্ষরোপণও করা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads